Tajin Ahmed ( তাজিন আহমেদ ) - JIBONER GOLPO - Hello 8920 - Educational Life Story by Story Teller

তিনি হাসতেন প্রাণ খুলে। তার হাসির শব্দ আমি টিনের ঘর থেকে শুনেছি বহুবার। বহু দূর থেকে। বিলবিলা শুটিং হাউজের শেষ মাথায় টিনের ঘর। ‌‘বিদেশি পাড়া’ নাটকের গল্পে সেই ঘর ছিল তাজিন আহমেদ আর মম মোরশেদের। সেই ঘরে শুটিং হতো সন্ধ্যার পর থেকে। আমি একটার পর একটা সিন করেই যেতাম। তাজিন আপা কোনও দিন বিরক্ত হতেন না। বলতেন না, ‘হিমু আজ থাক। অনেক সিন তো হলো।’ বাড়ি যাওয়ার তাড়া সবার ছিল, শুধু তার ছিল না! অথচ সেই মানুষটা কতো তাড়াতাড়ি, কী নিদারুণ অভিমানে শেষ বাড়িতে চলে গেলো। যে বাড়ি থেকে আর ফিরে আসা যায় না! সে রাতে কুয়াশা ছিল খুব। লাইট করতে ক্যামেরাম্যান সময় নিচ্ছিলো অনেক। আমি আর প্রিয়া আমান অনেক সময় ধরে তাজিন আপার গল্প শুনলাম। কাঁঠাল গাছের নিচে হিমধরা ঠান্ডায় সেই রাতে তিনি আমাদের কোনও সুখের গল্প শুনাতে পারেনি। দূরের বিলে তাই কোনও ডাহুক ডাকেনি। একটাও জোনাকি জ্বলেনি শিশির ভেজা ঘাসে! আমরা দুজন একের পর এক দুখের গল্প শুনেছি। তাজিন আহমেদ বলে গেছেন তার মায়ের গল্প, মিথ্যা ভালোবাসার গল্প, ভাই-বোন আর বাবা না থাকার গল্প। প্রিয়াকে বলছিল, বাসায় ঢুকলে খুব ভয় লাগে রে। রাতে ঘুমাতে পারি না ভয়ে। একা থাকতে কষ্ট হয় অনেক। যে মানুষটা ভয় পেতো, রাতে লাইট জ্বালিয়ে রাখতো, সে মানুষটা একা, একটা অন্ধকার ঘরে কীভাবে আছে এখন? কেমন করে আছে! আমার জানতে ইচ্ছে করে! ভীষণ ইচ্ছে করে! ‘বিদেশি পাড়া’ নাটকে তাজিন আহমেদকে কাস্ট করার কথা প্রিয়া আমান বলে। সারাদিন শুটিং করে রাত ১২টায় আমি ফোন দেই তাজিন আপাকে। পরিচয় দেই নিজের। তাজিন আপা পরের দিন থেকেই শুটিং শুরু করেন আমার সাথে। দুই দিন শিডিউল নেওয়ার পর আমি তার শিডিউল বাড়াই। নাটকের গল্পের প্রয়োজনে নয়, জীবনের গল্পের প্রয়োজনে তাজিন আহমেদ আমার সেটে নিয়মিত হন। কিছু কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী আমাকে সাবধান করেন—তাজিন আহমেদকে বাদ দিতে অথবা তার চরিত্র কমিয়ে দিতে। আমি কিছুই করিনি। কারণ, আমি জানি, আমি বা আমরা অসংখ্য মুখোশ পরা মানুষ নিয়ে কাজ করি। প্রতিদিন গল্পের প্রয়োজনে যারা চরিত্র বদল করে, তাদের আমি কিইবা বলতে পারি! ‘বিদেশি পাড়া’ নাটকে ২৭ জন আর্টিস্ট ছিল। কারো জন্য চুক্তিপত্র লাগেনি। কাউকে চুক্তিপত্রে সই করে অভিনয় করাতে হয়নি। অথচ কিছু আর্টিস্ট রোজ আমাকে বুদ্ধি দিতো, আমার প্রডিউসার রিপনকে ফিস ফিস করে বলতো, তাজিন আহমেদকে চুক্তিপত্রে সই করিয়ে নিন! না হলে ঝামেলা করতে পারে। না। তিনি কোনও দিন ঝামেলা করেননি। তার কোনও ডেট ফাঁসানোর গল্প আমার সাথে নেই। দেরি করে আসার গল্প আমার সাথে নেই। চাওয়া পাওয়ার গল্প আমার সাথে নেই। তাজিন আহমেদ আসলে দুর্ভাগা। বছরের পর বছর একসাথে কাজ করার পরও অনেক কো-আর্টিস্টের্ কাছ থেকে তিনি ভালোবাসা পাননি বলেই দুর্ভাগা। ভালো অভিনয় করার পরও নিজের জন্য কিছু করতে পারেননি বলে দুর্ভাগা। নির্মাতাদের দৃষ্টির বাইরে তাজিন আহমেদকে সরিয়ে রেখেছিলেন তারই প্রিয় মানুষরা। ভালোবাসার কিছু কো-আর্টিস্ট! বোকা মানুষটা সে কথা বুঝতেই পারলো না কোনও দিন। জানতেই পারলো না, তার অস্তিত্ব কতো সহজে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল টিভি পর্দা থেকে! মায়ের হাত ধরেই অভিনয়ে আসেন তাজিন আহমেদ। মা দিলারা জলির প্রোডাকশন হাউজ ছিল। ‘নাট্যজন’ নাটকদলের হয়ে তিনি মঞ্চে কাজ করেছেন। ২০০০ সালে ‘আরণ্যক’ নাট্যদলে যোগ দিয়ে জীবনের শেষ পর্যন্ত আরণ্যকের সাথেই ছিলেন। বিটিভির স্বর্ণালী সময়ে টিভিনাটকে অভিনয় করে দর্শকের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন তাজিন আহমেদ। বিটিভির সময়টাতে একচ্ছত্র জনপ্রিয়তা ছিল তাজিন আহমেদের। অসংখ্য নাটকে আজিজুল হাকিম, জাহিদ হাসান ছিলেন তাজিনের সহ অভিনেত্রী। রেডিও এবং টেলিভিশনে উপস্থাপনাও করতেন তাজিন। লেখালেখিও করেন তিনি। তাজিনের লেখা ও পরিচালনায় তৈরি হয় ‘যাতক’ ও ‘যোগফল’ নামে দুটি নাটক। তার লেখা উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হচ্ছে ‘বৃদ্ধাশ্রম’, ‘অনুর একদিন’, ‘এক আকাশের তারা’, ‘হুম’, ‘সম্পর্ক’ ইত্যাদি। তাজিন আহমেদের জন্ম ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই নোয়াখালী জেলায়। তিনি বেড়ে উঠেছেন পাবনা জেলায়। তাজিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর করে ভোরের কাগজ, প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। আনন্দ ভুবন ম্যাগাজিনের কলামিস্টও ছিলেন তিনি। পরে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সঙ্গীত শিল্পী ও পরিচালক রুমি রহমানের সাথেই সংসার জীবনে আবদ্ধ ছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ জীবনে একাকী জীবন কাটছিল তাঁর। আজ মঙ্গলবার বিকেল ৪ টা ৩৪ মিনিটে তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী তাজিন। মঙ্গলবার দুপুর ১২ টার দিকে তাজিন তার উত্তরার বাসাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর দ্রুত তাকে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাজিন আহমেদের এজমার সমস্যা ছিল। তাঁকে আইসিউতে নেওয়া হয়। কিন্তু আর ফেরেন নি তিনি।